ধর্ম ডেস্ক:
আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভে হৃদয় পবিত্র বা আত্মশুদ্ধির বিকল্প নেই। সাধুতা শুধু বাহ্যিক সাধুতা নয় বরং বিশ্বাসের পবিত্রতা, কর্মের পবিত্রতা, শারীরিক ও মানসিক পবিত্রতা, আর্থিক পবিত্রতা, বাহ্যিক ও ইন্টারনাল পবিত্রতা, পরিবেশের পবিত্রতা বুঝায়।
এক কথায় সর্বক্ষেত্রে পবিত্রতা অবলম্বনের শিক্ষা আমরা পবিত্র কুরআন থেকেই পেয়ে থাকি। কেননা আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, সে ব্যপারে কোনো অবস্থান নিও না। নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু, হৃদয়, এগুলোর প্রতিটি সম্মন্ধে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৩৬)।
আমরা যদি নিজেকে নিয়ে আত্মবিশ্লেষণ করি তাহলে প্রত্যক্ষ করব আমাদের কর্মময় জীবনের বেশিরভাগই চলছে অপবিত্রতার মধ্য দিয়ে। কেননা আমি যখন কোনো ব্যপারে প্রতিশ্রুতি করি সেই সময় তা ভঙ্গ করছি, ব্যবসায় বহু মুনাফা লাভের জন্য বাজারে মানব নির্মিত তৈরি করছি।
এক কথায় এরূপ কোনো পাপ বিদ্যমান কি যা আজ আমার দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে না? এজন্য আমাদের দরকার আত্মশুদ্ধির। আমাদের হৃদয় পবিত্র না করে যত বেশ ভালো কাজই করি না কেন কোনো লাভ নেই। রমজানের ত্রিশ রোজা রাখলাম, পর্যাপ্ত মানুষকে ইফতার করালাম, দান-খয়রাত করলাম তা সত্ত্বেও নিজ আত্মশুদ্ধির দিকে দৃষ্টি দিলাম না এতে কিন্তু আমার কোনো লাভ নেই।
কেননা হাদিস শরিফে এসেছে, ‘জেনে রেখ, মানুষের শরীরের মধ্যে একখণ্ড মাংসপিণ্ড আছে, যখন তা সংশোধিত হয়, সেই সময় শরীর সংশোধিত হয়ে যায়। আর যখন তা দূষিত হয়, তখন অবিরাম শরীর দূষিত হয়ে যায়। মনে রেখ, সেটাই অন্তর।’ (সহিহ বুখারি)।
মহানবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই স্রষ্টা তোমাদের আকৃতি ও সম্পদের দিকে তাকান না, বরং তিনি তোমাদের হৃদয় ও সৎকর্মের প্রতিই লক্ষ করেন। এরপর রাসূল (সা.) হৃদয় দেখানোর জন্য আঙুল দিয়ে নিজের বুকের দিকে ইশারা করেন।’ (সহিহ্ মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৪)।
আমরা আমাদের ওয়াজ নসিহতে তার সাথে নানারকম বক্তৃতায় অপরকে অনেক বেশ ভালো জ্ঞান দিয়ে থাকি কিন্তু নিজেই তা পালন করি না। এমনটি হলে সেই উপদেশ কাজে আসবে না। আমরা যদি নিজে সৎভাবে চলি আর অন্যদেরও সৎপথে চলার নির্দেশ দেই, তবেই ১টি অনুকরণীয় কমিউনিটি ও দেশ গড়তে পারে। এইজন্য প্রথমে আমাদের নিজেদের সৎ ও পবিত্র অন্তরের অধিকারী থেকে হবে।
বিশেষ করে আল্লাহতায়ালা যেসব কাজ হারাম করেছেন, তা হতে বেঁচে থাকা একজন মুমিনের পরম কর্তব্য। এজন্য প্রথমে নিজে সৎ ও পবিত্র বুকে হব, সব ধরনের হারাম কাজ পরিত্যাগ করব, অতঃপর অন্যকে সৎ থেকে উৎসাহিত করব। চলার রাস্তায় দিন দিন পর্যাপ্ত ভালো না বিষয় আমাদের দৃষ্টিতে পড়ে। আমাদের উচিত, সেগুলোকে প্রতিহত করা।
যেভাবে মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা যদি ভালো না কিছু দেখ তাহলে নিজ হাতে তা দূর কর, আর তা নিজ হাতে না পারলে নিজ জিহ্বা দ্বারা একে মন্দ বলে নিষেধ কর, আর তবুও যদি না পার, তাহলে মনে মনে ইহাকে ঘৃণা কর ও দোয়া কর আর এমন করাটা বিশ্বাসের দিক হতে সর্ব নিম্ন পর্যায়ের।’ (মুসলিম)।
নৈতিক অধঃপতনের এক চরম সীমায় আজ আমরা বসবাস করছি। যে দিকেই তাকাই, শুধু মন্দকর্মই যেন ছেয়ে আছে। আজ আমরা পার্থিব পৃথিবীর মোহে আল্লাহর অসন্তুষ্টির রাস্তায় ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছি। ভালো-মন্দের ডিফারেন্স করা ভুলে গেছি। দুষ্কৃতি করার জন্য করতে এইরকম হয়ে গিয়েছে যে পাপকে পাপই মনে হয় না।
হাদিসে সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবি (সা.) বলেছেন, আমি আমার উম্মতের একদল সম্মন্ধে নিশ্চয়ই জানি, যারা কিয়ামতের দিন তিহামার শুভ্র পর্বতমালার সমতুল্য নেক আমলসহ উপস্থিত হবে। মহামহিম আল্লাহ সেগুলোকে আকীর্ণ ধূলিকণায় রুপান্তর করবেন। সাওবান (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের পরিচয় ভালোভাবে আমাদের নিকট বর্ণনা করুন, যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অধিভুক্ত না হই। উনি বলেন, তারা তোমাদেরই ভ্রাতৃগোষ্ঠী তার সাথে তোমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা রাতের বেলা তোমাদের মতো ইবাদত করবে। তা সত্ত্বেও তারা এইরকম যে একান্ত গোপনে আল্লাহর হারামকৃত বিষয়ে লিপ্ত হবে। (ইবনে মাজাহ)।
আসলে মানুষের সম্মুখে নিজেকে আমরা পর্যাপ্ত সৎ ও মুমিন বানিয়ে রাখি অথচ আমাদের হৃদয়গুলো পাপে ভরপুর। যার ফলে আল্লাহর রহমত থেকে আমরা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি। রহমতের বৃষ্টির ফোঁটা আমাদের ওপর আর বর্ষিত হলো না। ঝামেলার পর বিপদ আসছে, একটি ঝুকিপুর্ণ যাওয়ার আগে আরেকটি বিপদ উপস্থিত। এসব দেখেও আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না যে আমাদের আত্মশুদ্ধির চাই রয়েছে।
বিশ্বময় করোনায় লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, এটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করেও যদি আমি আত্মশুদ্ধির চেষ্টা না করি তাহলে আমার চেয়ে বোকা আর কে আছে। দুষ্কৃতি কাজ পরিহার করে সৎ রাস্তায় চলার সময় কি এখনো আসেনি? তবুও স্রষ্টা এবং তার রাসূল (সা.) আমাদের সতর্ক করে গেছেন আমরা যেন সৎ কাজে লিপ্ত থাকি। আমরা যদি সৎকাজ ও শুদ্ধতা নির্ভর করি, তাহলে খোদা পাকের কৃপার চাদরে আমরা আচ্ছন্ন থাকব আর আল্লাহর নিরাপত্তায় থাকে তাহলে দুনিয়ার বিপদ আমাদের কোনো ক্ষতি করার জন্য পারবে না।
রমজানের ফরজ রোজা বা আদার্স দিনের নফল রোজা, যে রোজাই হোক না কেন তা আমাদের আত্মার সংশোধনের রিজন হয়ে থাকে। আর বিশেষ করে পবিত্র মাহে রমজানের রোজা আমাদের একটানা সালের দোষত্রুটি ক্ষমার কারণ হয়।
কেননা, ব্যক্তি যখন আল্লাহতায়ালার জন্য জাগতিক আরাম-আয়েশ, চাওয়া-পাওয়া প্রভৃতি হতে বিরত থাকে সেই সময় সে তার নফসকে পুণ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য অধিক শক্তি পায়। কিন্তু এ ব্যাপারটা ভাবনা রাখা উচিত, রোজার প্রকৃত ফোকাস কেবলমাত্র উপবাস থাকাই নয়। যদি উপবাস থাকার ফলে খোদার জান্নাত পাওয়া যেত তাহলে প্রত্যেকটি লোক এ জান্নাত পাওয়ার চেষ্টা করত।
কেননা উপবাস থেকে মৃত্যুবরণ করে নেওয়াটা তেমন কোনো শক্ত বিষয় নয় বরং দৃঢ় বিষয় হলো আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক পরিবর্তন সাধন করা। স্রষ্টা পাক আমাদের সব ধরনের ভালো না থেকে বেঁচে চলার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক : ইসলামি রিসার্চার ও কলামিস্ট

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন