সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণা আর বৈষম্যের বেড়াজাল ডিঙিয়ে শিক্ষার আলোয় নিজেকে আলোকিত করার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ২৭ বছর বয়সী তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) রবিউল খন্দকার মাহি। মঙ্গলবার রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে তিনি মাস্টার্স ১ম পর্বের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন, যার পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল রংপুর সরকারি কলেজ। এটি কেবল মাহির ব্যক্তিগত জয় নয়, এটি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের এক নীরব আহ্বান।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ১১নং বড়বালা ইউনিয়নের কুড়ার পাড় গ্রামের মোঃ ইলিয়াস হোসেন ও মোছাঃ ফৌজিয়া বেগমের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় মাহি।
জানা যায়, মাত্র ৭ বছর বয়সেই তিনি বুঝতে পারেন যে, তিনি অন্যদের থেকে আলাদা। এই উপলব্ধি তাকে তার মতো অন্য মানুষদের খুঁজে বের করতে উৎসাহিত করে এবং তিনি চলে যান রংপুরের পীরগন্জ উপজেলায় খালাশপীরহাটে। গত প্রায় ১৮ বছর ধরে তিনি পীরগঞ্জের খালাশপীর হাটে হিজড়া সর্দার সাইফুল ইসলাম স্মৃতির সাথে বসবাস করছেন বলে জানা গেছে।
এই দীর্ঘ সময়ে তিনি পীরগঞ্জের একজন ভোটার হিসেবেও নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অর্ধশতাধিক তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিকের বাস।
শিক্ষাজীবনের পরিক্রমা ও সামাজিক অবদানঃ
মাহির শিক্ষাজীবনের পথচলা ছিল দৃঢ়সংকল্প ও অধ্যবসায়ের এক অনন্য উদাহরণ। মিঠাপুকুর উপজেলার পূর্ব বড়বালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিএসসি) সম্পন্ন করেন। এরপর ২০১৫ সালে ছড়ান দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে এসএসসি এবং ২০১৭ সালে কেশবপুর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ২০২০ সালে খালাসপীর বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজ থেকে বিএসএস ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে এমএ ১ম বর্ষে ভর্তি হন। সেশন জটের কারণে ২০২২ সালের পরীক্ষা ২০২৫ সালে হলেও, তার পড়ালেখার প্রতি নিষ্ঠা বিন্দুমাত্র কমেনি।
পড়ালেখার পাশাপাশি মাহি নিজেকে মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করেছেন। তিনি ধর্মীয় ও সমাজসেবামূলক বিভিন্ন কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ২০১৯ সালে সরকারিভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং তিনি ভাতাভোগী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ব্লাড ডোনেশন সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথেও তিনি নিবিড়ভাবে জড়িত।
ভবিষ্যতের স্বপ্ন ও বৈষম্যের বাস্তবতাঃ
নিজের ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে মাহি বলেন, "আমি মাস্টার্স শেষে পরিবার পরিকল্পনা বা সমাজসেবা বিভাগে সরকারি চাকরি করে মানুষের সেবা করতে চাই। কারণ আমি তো বিয়েও করতে পারবো না। আমরা প্রতিটি পদেই বৈষম্যের শিকার হচ্ছি।" তার এই কথাগুলো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের দৈনন্দিন জীবনের কঠিন বাস্তবতার এক প্রতিচ্ছবি।
মাহি আরও জানান, তার জীবনের কোনো পিছুটান নেই। তিনি দরিদ্র ও অসহায় রোগীদের বিনামূল্যে রক্ত ব্যবস্থা করে দেন এবং নিজেও রক্তদান করেন। এছাড়াও মসজিদ ও মাঠ উন্নয়ন, ওয়াজ মাহফিলসহ অন্যান্য ধর্মের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানেও তিনি সাধ্যমতো সহযোগিতা করেন। ভূমিহীন এই মানুষটি নিঃস্বার্থভাবে সমাজের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
হিজড়া সর্দার সাইফুল ইসলাম স্মৃতি জানান, সরকারিভাবে পীরগঞ্জ উপজেলায় ৫৪ জন হিজড়া রয়েছেন। তারা সমাজের কাছে কেবল সামাজিক মর্যাদাটুকুই প্রত্যাশা করেন।
রবিউল খন্দকার মাহি নিঃসন্দেহে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য এক অনুপ্রেরণার প্রতীক। তার এই সংগ্রামী পথচলা সমাজের সকল স্তরে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের প্রতি সম্মান ও সহানুভূতির বীজ বুনে দিক, এই প্রত্যাশাই সকলের।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন