রংপুর জেলার পরিচিতি ইতিহাস ও ঐতিহ্য

 

জেলা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী জনপদ। শত রঙে শতরঞ্জি খ্যাত এই জেলার রয়েছে গৌরবময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ইতিহাস। জেলার প্রায় ৮০ শতাংশ তিস্তার প্লাবন জমি ও ২০ শতাংশ বরেন্দ্রভূমির অন্তর্গত।  রংপুর জেলা রংপুর বিভাগের ১টি প্রশাসনিক অঞ্চল ও বিভাগীয় শহর। ২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি, রংপুরকে রাষ্ট্রের ৭ম ক্যাটাগরি হিসেবে অ্যাপ্রুভ দেওয়া হয়।

রংপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস :

অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, রংপুরের নামকরণের ক্ষেত্রে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজীর ভূমিকা গ্রহণযোগ্য। ‘রঙ্গপুর’ শব্দটি ফারসি শব্দ। এইজন্য সঙ্গত কারণে বখতিয়ার শাসনামলেই রংপুরের নাম ‘রঙ্গপুর’ হয়েছে।

• লোকমুখে চলমান বিদ্যমান যে আগের ‘রঙ্গপুর’ থেকেই কালক্রমে এই নামটি এসেছে। ইতিহাস হতে জানা যায় যে, উপমহাদেশে ইংরেজরা নীলের চাষ আরম্ভ করে। এই অঞ্চলে মাটি ফলপ্রদ হবার কারণে এখানে প্রচুর নীলের চাষ হত। সেই নীলকে স্থানীয় লোকজন ‘রঙ্গ’ নামেই জানত। কালের বিবর্তনে সেই রঙ্গ থেকে রঙ্গপুর তার সাথে তা থেকেই আজকের রংপুর।

• অপর একটি চলমান আন্দাজ হতে জানা যায় যে, মহাভারতের টাইম প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজাভগদত্তের রঙমহল ছিল রংপুরে। সেই রঙমহল থেকে ‘রঙ্গপুর’ নামটি এসেছে। কারও মতে, ভগদত্তের মেয়ে পায়রাবতীর নামানুসারে মেয়ে জাগরণের পথপ্রদর্শক বেগম রোকেয়ার জন্মভূমি পায়রাবন্দের নামকরণ হয়েছে।

• রংপুর জেলার অপর নাম জঙ্গপুর । ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব থাকায় কেউ কেউ এই জেলাকে যমপুর বলেও ডাকত। তা সত্ত্বেও রংপুর জেলা সুদুর অতীত থেকে আন্দোলন প্রতিরোধের হেতু ঘাঁটি ছিল। তাই জঙ্গপুর নামকেই রংপুরের আদি নাম হিসেবে ধরা হয়। জঙ্গ অর্থ যুদ্ধ, পুর অর্থ টাউন বা শহর। গ্রাম হতে আগত  প্রায়ই ইংরেজদের অত্যাচারে নিহত হত বা ম্যালেরিয়ায় মারা যেত। এজন্য সাধারণ  শহরে আসতে ভয় পেত।

• সুদূর অতীতে রংপুর জেলা যে রণভূমি ছিল তা সন্দেহাতীত ভাবেই বলা যায়। ত্রিশের দশকের সমাপ্ত ভাগে এ জেলায় চাষি আন্দোলন যে ভাবে মার্কেটিং লাভ করে ছিল তার কারণে রংপুরকে লাল রংপুর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।

• কেউ কেউ মনে করেন, রংপুরে বস্ত্ররঞ্জনী কারখানা ছিল। পাট নির্মিত পোশাকে বা চটে রঙ করা হতো বলে রংপুরকে বলা হতো ‘রংরেজপুর’। এর পরিবর্তে হয়ে গিয়েছে রঙ্গপুর (রংপুর)। 


রংপুর জেলার ইতিহাস: 

হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী ইন্ডিয়ার পূর্বাংশ কামরূপ বা প্রাগজ্যোতিষ রাজ্যের  পাওয়া যায়, যার অন্তর্গত ছিল সাম্প্রতিক রংপুর তথা রঙ্গপুর অঞ্চল। সম্রাট ভগদত্তের টাইম (খ্রিস্টপূর্ব ১৫শ’ অব্দ) রংপুর প্রাগজ্যোতিষের অধিভুক্ত ছিল। আবার সম্রাট সাগর গুপ্তের টাইম (৩৪০ খ্রি.) কামরূপের করদ রাজ্যে পরিগণিত হয়। পরবর্তীতে আবার এই এরিয়া কোচবিহারের কয়েকটি অংশ হিসেবে চালিত হতো। চতুর্থ শতাব্দীর মধ্য হতে এ এরিয়া সর্বপ্রথম বর্মা রাজবংশের অধিভুক্ত হয়। কালক্রমে পালবংশ, সেনবংশ এ জাতীয় প্রচুর রাজবংশ এখানে রাজত্ব করে।

১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরকে সেনাপতি মানসিংহ রংপুরের অংশ বিশেষ অধিকার করেন। ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে রংপুর সম্পূর্ণভাবে মোঘল সম্রাজ্যভুক্ত হয়। আজও এ এরিয়ায় মোগল শাসনের স্মৃতি বহন করছে কুড়িগ্রামের মোগলবাসা ও মোগলহাট। মোগল আমলে রংপুর ছিল ঘোড়াঘাট সরকারের অন্তর্ভুক্ত। ‘বিয়াজুস সালাতীন’ নামক অতীত বৃত্তান্ত গ্রন্থে রঙপুর ঘোড়াঘাটের নাম পাওয়া যায়। এজেন্সি আমলে ফকির সন্ন্যাসী আন্দোলন ও প্রজা বিদ্রোহ এখানকার ইম্পোর্টেন্ট  ঘটনা।

আইন-ই-আকবরীর বিবরণ অনুযায়ী মোঘল রংপুর ৩ ধরনের প্রশাসনিক অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে ঘোড়াঘাটে মোগলদের ১টি ফৌজদারী হেড কোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। সেইম স্থানে কাকিনা, কাজিরহাট, ফতেহপুর মোগলদের অধীনে আসে এবং ২৪ বছর পর ১৭১১ খ্রি.  রংপুরে মোগল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর তিন দশকের শুরুতে মাহিগঞ্জে পর্যন্ত মোগল ইতিহাসের আর তেমন কোন পাল্টানো ঘটেনি। 


১৭৬৫ সালে ইস্ট ভারত কোম্পানি দেওয়ানী লাভের পর রংপুর নতুন আয়োজনে ইংরেজ শাসনাধীন আসে। রংপুর অঞ্চলে সর্বপ্রথম ১৭৬৫ সালে কৃষিজীবী বিদ্রোহ লক্ষ্য দেয়। ১৮৫৭ বছরের সিপাহী বিপ্লবে বিদ্রোহী সিপাহীরা। এ এরিয়ায় ইংরেজ শাসকদের মাঝে ত্রাসের সঞ্চার করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে রংপুরের নানারকম এরিয়ায় সর্বপ্রথম কংগ্রেসের ডেকে আনে আইন ভায়োলেট আন্দোলন চালু হয়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর এখানে উত্তরবঙ্গের কৃষক নেতাদের বৈঠক সংঘটিত হয় তার সাথে নভেম্বরে তেভাগা আন্দোলন চালু হয়।

মুক্তিযুদ্ধ : স্বাধীনতাকামী রংপুরের মানুষ ১ম সংঘাত শুরু করে ৩ মার্চ। মহান মুক্তিযুদ্ধের ১ম শহীদ রংপুরের শংকু সমজদার। ৩ মার্চ ৩ জনের প্রাণদানের সাহায্যে শুরু হয় রংপুরের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে রংপুরে সকল শ্রেণীর ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন। ৩ মার্চ হতে ৫ মার্চ রংপুরে কারফিউ চলে। এ অঞ্চলের মানুষ সশস্ত্র সংঘাত আরম্ভ করে ২৪ মার্চ। ২৮ মার্চ রোববার রংপুরের মানুষ জেগে উঠেছিল এক নবচেতনায়। এদিন লোক লাঠিসোটা নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানী সৈন্যরা বিক্ষুব্ধ হয়ে সাধারণ জনগণের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। করেছে নির্মমভাবে অত্যাচার। রংপুর অসংখ্য লোক প্রাণ দিয়ে প্রস্তুত করে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস। 


ভৌগোলিক অবস্থান: 

রংপুর জেলা ২৫০০৩’ থেকে ২৬০০০’ জবাব অক্ষাংশ তার সাথে ৮৮০৫৭’ থেকে ৮৯০৩২’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। রংপুর জেলার জবাবে লালমনিরহাট, পূর্বে কুড়িগ্রাম, দক্ষিণ-পূর্বে গাইবান্ধা, উত্তর-পশ্চিমে নীলফামারী তার সাথে দক্ষিণ-পশ্চিমে দিনাজপুর জেলা অবস্থিত। তিস্তা দরিয়া জবাব ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তকে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলা হতে পৃথক করেছে। রংপুর জেলার সর্বমোট আয়তন ২,৩৬৭.৮৪ বঃকিঃ। ৮টি উপজেলা, ৭৬টি ইউনিয়ন, ৩টি সিটি কর্পোরেশন ও ১২১৪টি মৌজা নিয়ে জেলাটি গঠিত।

রংপুর জেলার উপজেলা

রংপুর জেলায় ৮টি থানা রয়েছে। এগুলো হল:

• কাউনিয়া,

• গংগাচড়া,

• তারাগঞ্জ,

• পীরগঞ্জ,

• পীরগাছা,

• বদরগঞ্জ,

• মিঠাপুকুর এবং

• রংপুর সদর।


জেলার নদ-নদী:

তিস্তা, ঘাঘট, মানাস, আখিরা, মরা নদী, টোপা, ধাইজান, বুলাই, বুড়িখোড়া-চিকলী, দুধকুমার, করতোয়া, যমুনেশ্বেরী

রংপুর জেলার দর্শনীয়স্থান : 

• কারমাইকেল কলেজ,

• তাজহাট রাজবাড়ী,

• মন্থনা জমিদার বাড়ি,

• ইটাকুমারী জমিদার বাড়ি,

• শ্রী জ্ঞানেন্দ্র নারায়ণ রায়ের জমিদার বাড়ি,

• ভিন্নজগত,

• রংপুর চিড়িয়াখানা,

• পায়রাবন্দ,

• ঘাঘট প্রয়াস পার্ক,

• চিকলির পার্ক,

• আনন্দনগর,

• দেবী চৌধুরাণীর পুকুর,

• তিস্তা সরণি ও রেল সেতু,

• মহিপুর ঘাট,

• মিঠাপুকুর শালবন,

এছাড়াও,মিঠাপিকুর বড় মসজিদ,  মিঠাপুকুর থানার রানিপুকুর ও লতিবপুর ইউনিয়নের নিঝাল, ভিকনপুর, মামুদপুর তিন গ্রামের সীমানায় অবস্থিত মোঘল আমলের “নির্মিত তনকা মসজিদ”। সেইম থানার ময়েনপুর ইউনিয়নের ফুলচৌকির মোঘল আমলের নির্মিত মসজিদ, সুড়ুং পথ, শালবনের ইন্টারনাল মন্দির, সহ প্রচুর পুরাতন স্থাপনা আছে এই গ্রামে।


রংপুর জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব :

• হেয়াত মামুদ, মধ্যযুগের কবি

• বেগম রোকেয়া, বাংলার মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত

• দেবী চৌধুরানী

• দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, ভারতীয় ভাস্কর, চিত্রশিল্পী তার সাথে ললিত কলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি

• খান বাহাদুর শাহ্ আব্দুর রউফ, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ

• মশিউর রহমান – সাবেক প্রধানমন্ত্রী

• আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, বাংলাদেশের ১ম উত্তম বিচারপতি ও ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি

• লেফটেন্যান্ট জেনারেল পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও ৬ষ্ঠ সেনাপ্রধান, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

• এম এ ওয়াজেদ মিয়া, খ্যাতনামা পরমাণু বিজ্ঞানী

• মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান –বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক সেনাপ্রধান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধা ও বীর বিক্রম।

• মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, মাননীয় মেয়র, রংপুর সিটি কর্পোরেশন

• মসিউর রহমান রাঙ্গা , জাতীয় পার্টির মহাসচিব ।

• টিপু মুন্সি , বাণিজ্য মন্ত্রী

• এইচ এন আশিকুর রহমান , রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্য

• আনিসুল হক, লেখক, নাট্যকার ও সাংবাদিক

• নাসির হোসেন,বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার

• সানজিদা ইসলাম,বাংলাদেশ মেয়ে ক্রিকেট দলের সদস্য

• মাহবুব আলম, সাহিত্যিক

• রফিকুল হক, ছড়াকার, সাংবাদিক

• আকবর আলী, ক্রিকেটার

(তথ্যসূত্র জাতীয় তথ্যবাতায়ন, উইকিপিডিয়া)

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন