শোষণের নীলে সম্ভাবনার হাতছানি রংপুর অঞ্চলে।

উত্তর বাংলা ২৪বিডি ডেস্কঃ

 একসময় ইউরোপের চাহিদা মেটাতে রংপুর অঞ্চলের কৃষকদের জোর করে নীল চাষ করার জন্য বশীভূত করত ব্রিটিশরা। ইংরেজ নীলকরদের অমানবিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ এ অঞ্চলের চাষিরা বিদ্রোহ করেছিলেন। নীলকরদের উপদ্রবের সাক্ষী হয়ে এখনও পর্যাপ্ত জায়গায় টিকে রয়েছে নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ। অধুনা দিন পাল্টেছে। নীল চাষে নতুন সম্ভাবনা দেখছেন এ অঞ্চলের কৃষকেরা। এই নীল ইংরেজদের সেই নীল নয়। এই নীলে রক্তের দাগও নেই। একটু বাড়তি উপার্জনের আশায় স্বেচ্ছায় নীল চাষ করছেন তারা।

এদিকে চাষীদের প্রেরণা জোগাতে নিখিল রায় নামে এক যুবক রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের সাইডে গঙ্গাচড়া উপজেলার হরকলি ঠাকুরপাড়া গ্রামে ২২ শতাংশ জমিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন নীল তৈরির কারখানা। ওখান শতাধিক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর রংপুর সদর, তারাগঞ্জ, গঙ্গাচড়া ও নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ থানায় নীল চাষ করছেন অল্পসংখ্যক হাজার কৃষক।

রংপুর সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার ও তারাগঞ্জ থেকে ৭ কিলোমিটার সরে গঙ্গাচড়ায় অবস্থিত কারখানায় যাওয়ার পথে সড়কের দুই ধারে ছড়ানো অঞ্চলে নয়নে পড়ে নীলখেত। নিখিলের নীল তৈরির কারখানায় দেখা গেছে, গ্রামের ২৫-২৬ জন মহিলা সেখানে নীল তৈরিতে ব্যস্ত।
জানতে চাইলে ঠাকুরটারী গ্রামের গোলাপী রানী বলেন, নিখিল দাদার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে নীল তৈরিসহ আনুষঙ্গিক কাজ করি। এতে সংসার ভালোভাবেই চলে যায়।
নীল বিদ্রোহের পর নীল চাষ অফ হলেও রংপুর এলাকায় নীলগাছ বিলুপ্ত হয়নি। ২০০৫ সাল হতে রংপুর ও নীলফামারীর নানারকম এরিয়ায় নীল চাষ হয়। স্থানীয় ল্যাংগুয়েজে নীলকে বলে ‘মালখড়ি।  জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য কৃষকেরা জমিতে নীলগাছ লাগিয়ে রাখতেন। আর বর্তমানে নীল চাষে যুক্ত কৃষকেরা জানেন, উদ্ভিদের যেকোনো অংশ মাটিতে পড়ে পচে গিয়ে প্রাকৃতিক সারের কাজ করে। নীলগাছ জমির নাইট্রোজেনের মাত্রা নির্ভুল রেখে উর্বরতা বাড়ায়।

মার্চ মাসের মাঝামাঝি নীলের বীজ বুনতে হয়। নীল অনেকটা ধইঞ্চা বৃক্ষের মতো, এতে তেমন যত্নের দরকার হয় না। বীজ বোনার ৯০ দিন পর পত্র কাটার যোগ্য হয়। জুলাই মাসের ১ম সপ্তাহে নীলের পল্লব খনন করা চালু হয়। আগস্ট মাস পর্যন্ত তিনবার উদ্ভিদ থেকে পল্লব খণ্ডন করা হয়। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বীজ সংগ্রহের জন্য গাছগুলো জমিতেই থাকে। অক্টোবর মাসে বীজ কালেক্ট করা হয়। নীলগাছের মাথা হতে ১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত ডাল পাতাসহ কাটতে হয়। পত্র কাটার পর মেক্সিমাম দুই ঘণ্টার মধ্যে পানিতে জাগ দিতে হয়। বড় চৌবাচ্চায় ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পল্লব জাগ দেওয়ার পর একটি নির্যাস পাওয়া যায়। পরে আরেক চৌবাচ্চায় পাতার সবুজ রঙের গাদকে আড়াই হতে চার ঘণ্টা অক্সিডাইজেশন করতে হয়।

এই টাইম সবুজ রঙের গাদ বায়ুর সাথে বিক্রিয়ায় নীল রঙের গাদে পরিণত হয়। সেটি ধলা মার্কিন কাপড়ে ছেঁকে নেওয়া হয়। অতঃপর নীল রোদে শুকানো হয় অথবা জ্বাল দেওয়া হয়। এখান থেকে কেক ও গুঁড়া আকারে নীল পাওয়া যায়। নীল তৈরিতে বিভিন্ন ধাপে সময়ের হেরফের হলে নীলের গুণগত মানের তারতম্য ঘটে। নীলগাছের ২৫০ কেজি সবুজ পত্র থেকে এক কেজি নীল পাওয়া যায়।

হরকলি গ্রামের নীলচাষি প্রদীপ কুমার বলেন, নীলগাছ স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে মালগাছ হিসেবে পরিচিত। এই উদ্ভিদ পাঁচ-ছয় ফুট লম্বা হয়। এগুলো জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তবুও নিখিলের কল্যাণে বর্তমান নীল চাষ করে কৃষকেরা অতিরিক্ত টাকা আয় করছেন।

তারাগঞ্জের বালাবাড়ি গ্রামের কৃষিজীবী মতিয়ার রহমান বলেন, প্রতি একর ভূমির নীলগাছ হতে প্রায় তিন হাজার কেজি পল্লব পাওয়া যায়। নিখিলের কারখানায় প্রতি কেজি পত্র চার টাকা দরে ক্রয় হয়। এই সংখ্যায় এক একর জমির নীলগাছের পাতার প্রাইস দাঁড়ায় ১২ হাজার টাকা। তা ব্যতীত প্রতি একর জমির শুকনা নীলগাছ জ্বালানি হিসেবে বিক্রি হয় ৯ থেকে ১০ হাজার টাকায়।

ঠাকুরটারী গ্রামের কৃষক ইন্দ্রজিৎ রায় বলেন, এক একর জমিতে নীলগাছের চাষ করেছি। তিন দফায় নীল পত্র বিক্রি করেছি ১৩ হাজার ৩০০ টাকা। জ্বালানি হিসেবে মালগাছ বিক্রি করেছি ৫ হাজার ৮০০ টাকার। আবার যে-সব তরু আছে, তা বিক্রি করার জন্য পারবো আরও তিন হতে চার হাজার টাকা। এক একর জমিতে আমার খরচ হয়েছে প্রায় ২ হাজার টাকা।

নিখিল রায় বলেন, আমি এসএসসি পাস করার পর ২০০২ সালে পল্লীচিকিৎসকের কোর্স করি। তারপর নিজ গ্রামে বিনা পয়সায় চিকিৎসাসেবা দেওয়া চালু করি। ২০০৩ সালে এলাকার অভাবী নারী-পুরুষদের সংগঠিত করে শুরু করি হস্ত কুটিরশিল্প প্রশিক্ষণ কল্যাণকেন্দ্র। ২০০৬ সালে ‘এমসিসি বাংলাদেশ’ নামক একটি সংস্থায় নীল তৈরির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে সংস্থাটির আর্থিক ও কারিগরি সাহায্যে আরম্ভ করি পল্লব হতে নীল তৈরির কাজ। সম্প্রতি আমার কারখানার তালিকাভুক্ত কৃষক ৭২০ জন। তারা প্রায় ২৫০ একর জমিতে নীলের চাষ করেন। আরও অন্তত ৩৯০ জন সাধারণ কৃষিজীবী রয়েছেন। তারা ১২৫ একর জমিতে নীল চাষ করেন।

নিখিল রায় আরও বলেন, প্রতি মৌসুমে আমার কারখানায় প্রায় অর্ধকোটি টাকা মূল্যের নীল প্রস্তুত হয়। কর্মচারীদের মজুরি দিয়ে যে লাভ থাকে, তা জমা হয় সংগঠনের নামে। কর্মচারীদের দুর্দিনে বা স্বার্থে ওই টাকা কাজে কষে বা শক্ত করে বাঁধা হয়।

রংপুর কৃষি প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, ব্রিটিশ আমলে রংপুর অঞ্চলের চাষিরা নীলকরদের অমানবিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নীল চাষ বন্ধের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন। আজকাল নিখিলের বদৌলতে রংপুর অঞ্চলের পর্যাপ্ত নীলচাষির মুখে হাসি ফুটছে।

(তথ্য সূত্র সংগ্রহীত)




Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন