জেসমিনের স্কুল তাদের ভরসা

 শিক্ষা ডেস্ক:


পৌরসভার সীমানা পেরিয়ে পিচঢালা রাস্তা দিয়ে আধা কিলোমিটার যেতে কানে ভেসে এল শিশুদের ঐকতান শরৎকালে কাশফুল ফোটে।’ এর খোঁজে পথের ডান পাশে তাকাতেই চোখে পড়ল প্লাস্টিকের মাদুরের ওপর বসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কাশফুলের কথা পড়ছে বেশ কতিপয় শিশু। তাদের পড়াচ্ছেন যে নারী, উনি জেসমিন সুলতানা।


নিজের গড়া স্কুলটিতে বিনে পয়সায় শিশুদের পড়ান উনি সপ্তাহে ছয় দিন, দুই ঘণ্টা করে। এগিয়ে গেলাম। দেখে মনে হলো, স্কুলটিতে যারা পড়ে, তাদের অধিকাংশই দুর্গত পরিবারের সন্তান। ছয় বছর আগে জেসমিন শুরু করেছিলেন স্কুলটি। এটিই এই শিশুদের একমাত্র ভরসার জায়গা।


স্কুলটি যশোর জেলার ঝিকরগাছা থানার মল্লিকপুর গ্রামের পূর্বপাড়ায়। জেসমিন সুলতানা সেখানকার অধিবাসী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তরিকুল ইসলামের স্ত্রী। ব্যক্তিগত জীবনে দুই ছেলে-মেয়ের মা। ২০১৩ সালে উনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সমাপ্ত করেন। সংসার সামলানোর পাশাপাশি ক্লান্তিহীনভাবে বিদ্যালয়টি চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।


মল্লিকপুর পূর্বপাড়া থেকে প্রাইমারি স্কুল দুই কিলোমিটার দূরে। অন্য দিকে মহাসড়ক ও রেললাইন রয়েছে। এইজন্য এ পাড়ার শিশুদের প্রাক্‌-প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য সেদিকের স্কুলে যাওয়াটা বেশ খানিক নিরাপত্তাহীন।


তা ছাড়া এ পাড়ার কাছাছাছি রয়েছে একাধিক ইটভাটা। ওই স্থান গ্রামের দরিদ্র অধিবাসীরা কাজ করেন। এজন্য সন্তানদের দূরের স্কুলে দেওয়া হয় না তাঁদের। ফলে জেসমিনের বিদ্যালয়টি এখন ওই গ্রামের মানুষের ‘আশার বাতিঘর’ হয়ে উঠেছে।

জেসমিন ছোটবেলা হতে লেখাপড়ার পাশাপাশি গৃহশিক্ষকের কাজ করতেন। একপর্যায়ে তাঁর এক স্বজনের অনুপ্রেরণায় বাড়ির ১টি অগ্রাহ্য ঘর বিদ্যালয় যোগ্য শিশুদের পড়ানো চালু করেন তিনি। স্কুলটিতে পড়ে ৪ থেকে ১২ বছরের শিশুরা।


স্কুলের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মুছা (১০) জানিয়েছে, তার জনক জাহিদ হোসেন ভ্যান চালান। প্রভাতে প্রচুর সময় বাবাকে কাজে সাহায্য করে বিকেলে স্কুলে আসে সে। জান্নাতুন খাতুন দ্বিতীয় ক্লাসে পড়ে। ঘর থেকে বিদ্যালয় প্রচুর দূরে, তাই এখানে পড়তে আসে। তিন বছর ধরে সে এই বিদ্যালয়ে আসে বলে জানায়।


মল্লিকপুর পূর্বপাড়ার অধিবাসী আছিরন খাতুন বলেন, রাষ্ট্রীয় স্কুল এখান থেকে প্রচুর দূরে। শিশুরা ওই স্থান যেতে পারে না। এ ছাড়া বেসরকারি বিদ্যালয়ে সন্তানদের পড়ানোর সক্ষমতা নেই। আর গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় অবস্থিত মল্লিকপুর কপোতাক্ষ গুচ্ছগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয় বহু দূরে না হলেও সেদিকে যেতে যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক ও রেললাইন অতিক্রম থেকে হয়। শিশুদের জন্য এটা ঝুঁকিপূর্ণ।


তাই ছেলে রিফাত হোসেনকে জেসমিনের বিদ্যালয়ে বিনা বেতনে পড়তে পাঠান আছিরন। স্কুলের শুধুমাত্র শিক্ষক জেসমিন নিজেই। ছয় বছর ধরে শিশুদের পড়াচ্ছেন তিনি। এর জন্য কোনো পারিশ্রমিক নেন না। কেবলমাত্র থানা শিক্ষা কার্যালয় থেকে শিশুদের পাঠ্যপুস্তক নেন প্রতিবছর।


৩০টি ছোট বাচ্চা নিয়ে বিদ্যালয়টি শুরু করেছিলেন জেসমিন সুলতানা। অধুনা ৬০ জন শিশুশিক্ষার্থী আছে তাঁর স্কুলে। কিন্তু এখান হতে দ্বিতীয় ক্লাস পর্যন্ত পড়ে যারা বেরিয়ে গেছে, তারা অনেকেই ঝরে পড়েছে। এজন্য এ পাড়ায় ১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে চান জেসমিন।


(তথ্য ও পিকচার সংগ্রহীত)

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন