বাংলার গ্রাম এলাকায় ঝোপ-ঝাড়ে খুব অযত্নে বেড়ে ওঠা সুস্বাদু মেটো আলু বা চুপড়ি আলু

উত্তর বাংলা ২৪বিডি ডেস্ক:


বাংলার গ্রাম এলাকায় ঝোপ-ঝাড়ে খুব অযত্নে লতানো একটা গাছ হয়। অপর গাছের সাহায্যে বেড়ে ওঠে। যেটাকে আমরা ঝোড়া আলু মেটো আলু বা চুপড়ি আলু বলি। গাছের মাটির নিচে হওয়া আলুটার সাইজ ২ থেকে ৫০ কেজি অবধিও হয়। মাছ দিয়ে রান্না করে খাওয়া হয়। বেশ সুস্বাদু এটা।

যারা খেয়েছেন বা জানেন, অবশ্যই জানাবেন কিন্তু!
এবার আসুন এটা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা নেই :
মেটে আলু কন্দালজাতীয় ফসল। আমাদের কান্ট্রিতে এটা সবজি হিসেবে ব্যবহারকৃত হয়। বাণিজ্যিকভাবে এর চাষবাস তেমনটি লক্ষ্য যায় না, কিন্তু দেশের প্রত্যেকটি জেলায় বাড়ির চারপাশে, উদ্ভিদের নিচে, মাচায়, আঙিনায়, বেড়ার ধারে এর চাষাবাদ লক্ষ্য করা যায়। মেটে আলু উষ্ণতা আবহাওয়ায় বেশ ভালো জন্মে।  ঠান্ডায় উদ্ভিদটি বৃদ্ধি পায় না, শীতে উদ্ভিদ শুকিয়ে মারা যায়। হালকা দো-আঁশ মাটি বেশি উপযোগী। এ উদ্ভিদটি অংশ বিশেষে ছায়াতে সুন্দর হয়। জীবিত উদ্ভিদের জন্য মাচা, জাংলা, বেড়া এসবের দরকার, কারণ এটা ১টি লতানো গাছ। অনেক ক্ষেত্রে জাংলা বা মাচার জন্য এক্সট্রা খরচ পড়ে না, কারন বাড়ির আশপাশের অগ্রাহ্য স্থান বা পথের ধারে উদ্ভিদের নিচেও চাষাবাদ লক্ষ্য করা যায়।
এটি ওল, গোল আলু এসব সবজির মতোই ভর্তা, মাছ ও মাংসের সঙ্গে রান্না করে  যায়। সুতরাং এর চাষ ব্যপারে একটু সচেতন হলে সবজির ঘাটতি মেটাতে পারে। বাড়ির আশপাশের অগ্রাহ্য স্থানে  কীটনাশক ও বালাইনাশক প্রয়োগ ছাড়াই এর চাষ তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে। মেটে আলু ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের খুবই অনেক ভালো উৎস। এছাড়াও পর্যাপ্ত পটাশিয়াম ও সোডিয়াম রয়েছে এতে।
গাছ  আলুটি একবীজপত্রী লতানো উদ্ভিদ। এই আলু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানারকম নামে পরিচিত লাভ করেছে। যেমন- গড় আলু, মেটে আলু, গুইচ্যা আলু, লেমা আলু, ধুসড়ী আলু, আলতাপাট, চুবডি আলু, হরিণখালি, মাছআলু, হাতি পায়া, মৌ আলু-মঘু আলু পুড়া আলু প্রভৃতি নামকর হলেও জাত ৪-৫টির মতো বিদ্যমান বলে জানা যায়। জাতভেদে মাটিরনিচে প্রত্যেকটি আলু ২ কেজি হতে ৫০-৬০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এসব কোনটা ডিম্বাকৃতি, লম্বাটে, হাতির পায়ের ন্যায়, হরিণের মাথার মতো প্রভৃতি আকারে হয়ে থাকে। জাতভেদে পিংক কালার, ধূসর/মেটে রঙের আলু হয়। মাটির নিচের আলু ব্যতীতও লতানো উদ্ভিদে ডিম্বাকৃতি ও লম্বাটে ১০০-১৫০ গ্রাম ওজনের প্রচুর আলু ঝুলন্ত পরিস্থিতিতে ধরে থাকে। লতায় ধরে বলে এটা কোনো কোনো এলাকায় পাতাশি নামে পরিচিত। এই পাতাশি বীজ হিসেবে, সবজি হিসেবে তার সাথে পুড়িয়ে বেশ মুখরোচক খাদ্য হিসেবে ব্যবহারকৃত হয়ে থাকে। অল্প আঠালো তার সাথে অল্পতেই সিদ্ধ হয় এইরকম গোত্রের আলু খেতে সুস্বাদু, চাহিদাও অনেক বেশি।

যেহেতু মেটে আলু অবিরাম বর্ষা মৌসুম জুড়ে থাকে, বিধায় ভারি বৃষ্টিপাতেও জল দাঁড়াবে না আবার সেচের সুব্যবস্থা রয়েছে এইরকম জমি/স্থান নির্বাচন করতে হয়।মেটে আলু লাগানোর এক মাস আগে ফাল্গুনে চাষ দিয়ে পুরো জমিতে ক্লিয়ারভাবে প্রচুর পরিমাণে জৈব সার ছিটিয়ে দিতে হবে, তার সাথে ৩-৪ হাত দূরত্বে ২ ফুট চওড়া ও ৩ ফুট অগাধ গর্ত করে ২০-২৫ দিন ধরে মাটি রোদে শুকানোর পর জৈবসার+ছাই চিটা একসঙ্গে মিশিয়ে প্রত্যেকটি গর্ত ভরাট করতে হবে। প্রত্যেকটি গর্তের মধ্যে রাসায়নিক সার-ফসফেট ৫০ গ্রাম ও পটাশ ৫০ গ্রাম দিয়ে রস না থাকে তাহলে সেচের অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে হবে। এর ১০-১২দিন পর মেটে আলুর (মাটির নিচের) মুখিকন্দ কিংবা লতায় যেটি ধরে ‘পাতাশি’তা বীজ হিসেবে বপন করতে হবে। জীবিত উদ্ভিদ আশ্রয়দাতা হলে উদ্ভিদের গোড়ার ২ হাতের ভিতরে মাদা প্রস্তুত করতে হবে। উদ্ভিদের গোড়ায় যেন জল জমে না থাকে সেজন্য জল নিষ্কাশনের নালার অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে হবে।
লাগানোরনিয়ম:
বীজ শোধন করে লাগালে এর উৎকৃষ্ট এবং শুধুমাত্র রোগ, গোড়া পঁচা রোগের হাত হতে রক্ষা পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের অ্যাপ্রুভড যে কোনো প্রতিষেধক ২ গ্রাম কিংবা ম্যানকোজেব গ্রুপের অ্যাপ্রুভড যে কোনো প্রতিষেধক ৩ গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৩০-৪০ মিনিট ডুবিয়ে রেখে, বীজ তুলে ছায়ায় শুকিয়ে গর্তের মধ্যে লাগাতে হবে। এছাড়া কাঁচা গোবর পানিতে গুলে ২ গ্রাম হারে কার্বেন্ডাজিম/ম্যানকোজেব দিয়ে তার ভিতরে বীজ/কন্দ ডুবিয়ে তুলে ছায়ায় শুকিয়ে লাগালে তাড়াতাড়ি অঙ্কুরোদগম এবং শোধিত হয়।

মুখী উপরদিকে রেখে মাটির ঊর্ধ্বের ধাপ হতে ৪ আঙুল তলে বীজ/কন্দ লাগাতে হবে। মাটিতে রস না থাকে তাহলে ১০-১৫ দিন অন্তর অন্তর সেচ দিতে হবে। এক্ষেত্রে লাগানোর স্থানে খড়/কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দেয়া যেতে পারে। হাফ কেজি হতে ২ কেজি ওজনের বীজ/কন্দ লাগালে অনেক ভালো ফলন পাওয়া যায়। এছাড়া ১ম বছর ফসল না তুলে রেখে দিলে পরের বছর এ হতে সুঠাম চারা বের হয় তার সাথে ওই চারা লাগালে ফলনও অধিক হয়। মার্চ এপ্রিল (ফাল্গুন-চৈত্র) মাসের মধ্যে এ আলু বপনের যোগ্য সময়।
চারা গজানোর পর থেকেই জমি/গাছের মাদা আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে গোড়ার মাটি বেশি  না হয় তার সাথে দাওয়ালি/কুরনি বা কোদালের চোট যেন উদ্ভিদে না লাগে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ এতে উদ্ভিদের গোড়ায় জলাবদ্ধতা তার সাথে গোড়া পঁচা রোগে ফলনের বিপুল লস হতে পারে।চারা লাগানোর এক মাস পর পর ২-৩ বার ইউরিয়া ৫০ গ্রাম তার সাথে পটাশ ৫০ গ্রাম হারে প্রত্যেকটি উদ্ভিদের গোড়ার চারপাশের মাটিতে ২-৩  আঙুল নিবিড়ে ব্যবহার করতে হবে। লতানো উদ্ভিদের অবলম্বন, মাচা যত চমৎকার হবে এবং উদ্ভিদ যত সম্প্রসারিত হতে পারবে মাটির নিচের আলু তত সুবিশাল হবে।

মেটে আলুতে রোগ তার সাথে পোকার আক্রমণ নেই বললেই চলে। কিন্তু কোনো কোনো ৰেত্রে শোষক পোকার আক্রমণ দেখা যায়। এক্ষেত্রে কীটনাশক হিসেবে সেভিন ব্যবহার করা যেতে পারে। রোগের ৰেত্রে মেটে আলুতে ছত্রাকের কারণে ডাঁটায় /লতায় শুরুতে বাদামি আঁচড় হয় তার সাথে পরে গোড়া/পাতা পচে ঢলে পড়ে। এক্ষেত্রে কপার অঙিক্লোরাইড গ্রুপের প্রতিষেধক ৪ গ্রাম পক্ষান্তরে কার্বেন্ডাজিম ২ গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে উদ্ভিদের গোড়ার  মাটি ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শামুকও লস করে থাকে। হাত দিয়ে শামুক মেরে এর হাত থেকে সহাজেই রক্ষা পাওয়া সম্ভব।মেটে আলু তোলা/সংগ্রহের সঠিক সময় মেটে আলুর আয়ুষ্কাল ৮-১০ মাস।

কার্তিক-অগ্রহায়ণে ঠান্ডা পড়তে আরম্ভ করলে পাতা হলদে হয়ে পুরো উদ্ভিদ শুকিয়ে যায়। পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে আলু তোলা উচিত। এতে আলু পরিপক্বতার কারণে বীজের মান পুষ্ট তার সাথে স্বাদ বৃদ্ধি পায়। ভাদ্র-আশ্বিন মাসের মধ্যে মেটে আলুর গোড়ার মাটি সরিয়ে মুখের অংশ সঠিক রেখে নিচের দিক হতে খাওয়ার জন্য কিছুটা আলু কেটে নেয়া যায়। এতে উদ্ভিদ মরে যায় না বরং ওই কর্তন করা ভাগে আলু  পূর্বের পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সুবিশাল হতে থাকে।  উন্মুক্ত জায়গায় চাষ করে মাদাপ্রতি মেক্সিমাম ৫০-৬০ কেজি পর্যন্ত গড় আলু পাওয়া সম্ভব। এছাড়া জাংলা/মাচায় চাষেও সন্তোষজনক ফলন পাওয়া যায়। বিঘাপ্রতি মেটে আলুর গড় ফলন ৩-৪ টন হয়ে থাকে।

উপসংহার:
অন্য সবজির তুলনায় এই সবজি উৎপাদনে ঝুঁকি, রোগবালাই অতিশয় কম। আমাদের দেশে মানুষের শারীরিক পুষ্টিহীনতা দূর করতে, সবজির ঘাটতি মেটাতে, পরিত্যক্ত স্থানের ঠিক ব্যবহার করতে, বিষমুক্ত সবজি পেতে ও আর্থিক স্বচ্ছলতা আনয়নে এ সবজিটি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে। মেটে আলু চাষের সাহায্যে আর্থিকভাবে লাভবান এবং উৎপাদনমুখী অগ্রগতি করা সম্ভব। মেটে আলু আদি কাল থেকে ব্যবহার হওয়া সত্ত্বেও এর বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় চাষাবাদে প্রসার-প্রচার হয়নি বিধায় ব্যাপকভাবে এর চাষের উন্নয়নও ঘটেনি। তা সত্ত্বেও একটু সচেতন হলে অধিক উৎকর্ষ ইজিলি কম খরচে সহজলভ্য সবজি মেটে আলু চাষ করা যায় যা কিনা পুষ্টির অভাব পূরণে প্রচুর অবদান রাখতে পারে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন